উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের আগমন একটি দীর্ঘ ও বহুমুখী প্রক্রিয়া। ইসলামের সূচনা থেকেই আরব বণিক ও ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে এই অঞ্চলে ইসলাম পরিচিতি লাভ করে। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের আগমন ঘটে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে।
সিন্ধু বিজয়: উপমহাদেশে ইসলামের প্রবেশ
উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের শাসনামলে (৭১২ খ্রিস্টাব্দ) মুসলিমদের বিজয় অভিযান শুরু হয়। এই সময় পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর শাসনকর্তা ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। তিনি তার জামাতা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে সিন্ধু রাজা দাহিরের বিরুদ্ধে অভিযানে পাঠান। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ছিলেন ইরাকের শাসক।
৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু জয় করেন, যার মাধ্যমে ভারতবর্ষে ইসলামের আগমন ঘটে। আরবদের এই অভিযানের সময় সিন্ধুর রাজা ছিলেন রাজা দাহির। মুহাম্মদ বিন কাসিম সর্বপ্রথম দেবল বন্দরটি জয় করেন। এই বিজয়ের ফলে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রীয়ভাবে উপমহাদেশে ইসলামের সূচনা হয়।
সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমণ
সুলতান মাহমুদ ছিলেন গজনীর শাসক (৯৯৭-১০৩০ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি মোট ১৭ বার ভারত আক্রমণ করেন। তার সভাকবি ছিলেন ফেরদৌসী, যিনি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘শাহনামা’ রচনা করেন। সাহিত্য ও দর্শনে তার অবদানের জন্য তাকে প্রাচ্যের হোমার বলা হয়।
সুলতান মাহমুদ ১০২৬ সালে ভারতের গুজরাটে অবস্থিত বিখ্যাত সোমনাথ মন্দির আক্রমণ করেন। তার রাজসভার আরেক বিখ্যাত দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ ছিলেন আল-বেরুনী।
দিল্লি সালতানাত: মুসলিম শাসনের উত্থান
দিল্লি সালতানাত বলতে মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে ১২০৬ থেকে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৩২০ বছর ধরে রাজত্বকারী একাধিক মুসলিম রাজ্য ও সাম্রাজ্যকে বোঝানো হয়। এই সময়ে বিভিন্ন তুর্কি ও আফগান রাজবংশ দিল্লি শাসন করে। ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে দিল্লি সালতানাতের পতন ঘটে।
দিল্লি সালতানাতের মোট পাঁচটি রাজবংশ ছিল: ১. দাস বংশ (১২০৬-১২৯০) ২. খিলজি বংশ (১২৯০-১৩২০) ৩. তুঘলক বংশ (১৩২০-১৪১৩) ৪. সৈয়দ বংশ (১৪১৩-১৫৫১) ৫. লোদি বংশ (১৪৫১-১৫২৬)
দাস বংশের উল্লেখযোগ্য শাসকগণ
- সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক (১২০৬-১২১০ খ্রিস্টাব্দ): তিনি ছিলেন দিল্লি সালতানাতের প্রথম স্বাধীন সুলতান এবং ভারতে স্থায়ী মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি মুহাম্মদ ঘুরীর একজন ক্রীতদাস হিসেবে জীবন শুরু করেন। তার উদারতা ও দানশীলতার জন্য তিনি 'লাখবক্স' নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি আজমিরে 'আড়াই দিনকা ঝোপড়া' মসজিদ এবং দিল্লিতে কুতুব মিনার নির্মাণ শুরু করেন।
- সুলতান শামসউদ্দিন ইলতুৎমিশ (১২১১-১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ): তাকে দিল্লির সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তিনি কুতুব মিনারের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করেন এবং চল্লিশজন তুর্কি ক্রীতদাসদের নিয়ে একটি দল গঠন করেন, যা 'বন্দেগান-ই-চেহেলগান' বা 'চল্লিশ চক্র' নামে পরিচিত ছিল। তিনিই প্রথম মুসলিম শাসক হিসেবে আরবীয় মুদ্রা 'রুপিয়া' প্রচলন করেন। বাগদাদের খলিফা তাকে 'সুলতান-ই-আজম' উপাধি প্রদান করেন।
- সুলতান রাজিয়া (১২৩৬-১২৪০ খ্রিস্টাব্দ): তিনি ছিলেন ইলতুৎমিশের কন্যা এবং দিল্লির সিংহাসনে আরোহণকারী প্রথম মুসলিম নারী।
- সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন (১২৬৬-১২৮৭ খ্রিস্টাব্দ): তাকে 'মহান শাসক' বলা হয়। তিনি শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় 'রক্তপাত ও কঠোর নীতি' (Blood and Iron Policy) গ্রহণ করেন। তার রাজসভা বিখ্যাত কবি আমীর খসরু দ্বারা অলংকৃত ছিল, যাকে 'ভারতের তোতা পাখি' বলা হয়।
খিলজি বংশ
- জালালউদ্দিন খিলজি: তিনি ৭০ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং খিলজি বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তার সময়ে মোঙ্গল নেতা হালাকু খানের পৌত্র আবদুল্লাহর নেতৃত্বে মোঙ্গলরা ভারত আক্রমণ করে, কিন্তু তিনি সাহসিকতার সাথে এই আক্রমণ প্রতিহত করেন।
- আলাউদ্দীন খিলজি (১২৯৬-১৩১৬ খ্রিস্টাব্দ): তিনি জালালউদ্দিনকে হত্যা করে সুলতান হন। আলাউদ্দীন প্রথম মুসলিম শাসক হিসেবে দাক্ষিণাত্য জয় করেন। তার সেনাপতি মালিক কাফুর এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন। তিনি দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা নেন। পাঞ্জাবের শাসনকর্তা গাজী মালিকের হাতে ১৩২০ খ্রিস্টাব্দে খিলজি বংশের পতন হয়।
তুঘলক বংশ
- মুহাম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৫-১৩৫১ খ্রিস্টাব্দ): তিনি শাসনের সুবিধার জন্য রাজধানী দিল্লি থেকে দেবগিরিতে স্থানান্তর করেন। এছাড়া, সোনা ও রূপার মুদ্রার পরিবর্তে প্রতীকী তামার মুদ্রা প্রচলন করেন। কৃষির উন্নয়নের জন্য তিনি 'দিওয়ান-ই-কোহী' নামে একটি স্বতন্ত্র কৃষি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন।
- ফিরোজ শাহ তুঘলক: সংস্কারক হিসেবে তার বিশেষ খ্যাতি ছিল। তিনি ২৩ প্রকার করের বিলোপ সাধন করেন এবং কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে ৯৬ মাইল দীর্ঘ খাল খনন করেন।
সৈয়দ বংশ ও লোদী বংশ
- সৈয়দ বংশ (১৪১৩-১৫৫১): এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খিজির খান, যিনি নিজেকে নবীজির বংশধর দাবি করতেন।
- লোদী বংশ (১৪৫১-১৫২৬): এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বাহলুল লোদী। ইব্রাহিম লোদী ছিলেন লোদী বংশের সর্বশেষ সুলতান।
দিল্লি সালতানাতের পতন
১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে মুঘল সেনাপতি বাবর লোদী বংশের শেষ সুলতান ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত ও হত্যা করে দিল্লি দখল করেন। এর মধ্য দিয়ে দিল্লি সালতানাতের অবসান ঘটে এবং মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়।
ইবনে বতুতার আগমন
মরক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা দুইবার ভারতবর্ষে আসেন। প্রথমবার তিনি ১৩৩৩ সালে তুঘলক বংশের মুহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলে আসেন এবং ৭ বছর কাজী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৩৪৬ সালে তিনি বাংলায় সোনারগাঁওয়ে আসেন ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের সময়ে। ইবনে বতুতা বাংলাকে 'দোযখপুর নিয়ামত' হিসেবে অভিহিত করেন। তার ভারতবর্ষ সফরের বর্ণনা তার রচিত ভ্রমণগ্রন্থ 'কিতাবুর রেহালাতে' পাওয়া যায়।
বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা
তুর্কি বীর বখতিয়ার খিলজী ১২০৩ সালে বিহার জয় করেন। এরপর ১২০৪ সালে তিনি নদীয়া আক্রমণ করে রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করেন এবং বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ১২০৬ সালে বখতিয়ার খিলজীর মৃত্যুর পর তার সহযোদ্ধাগণ বাংলা শাসন করতে থাকেন। এর পরে দিল্লির শাসকগণ বাংলাকে একটি প্রদেশে পরিণত করে শাসন করেন। এই সময়ে মোট ১৫ জন দিল্লির সুলতান বাংলা শাসন করেন।
বাংলায় তুর্কি শাসন (১২০৪-১৩৩৮)
এই সময়ে বাংলায় ঘন ঘন বিদ্রোহ হতো, যার কারণে দিল্লির ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারাণী তার 'তারিখ-ই-ফিরোজশাহী' গ্রন্থে বাংলাকে 'বুলগাকপুর' বা বিদ্রোহের নগরী বলে অভিহিত করেন।
- সুলতান গিয়াসউদ্দীন ইওয়াজ খিলজি: মুসলিম শাসকদের মধ্যে তিনিই প্রথম নৌবাহিনী গড়ে তোলেন।
- সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ: তার সময়ে সিলেট বিজিত হয় এবং হযরত শাহজালাল (র.) বাংলাদেশে আসেন। তার নামানুসারে সিলেট অঞ্চল এক সময় 'জালালাবাদ' নামে পরিচিত হতো।
স্বাধীন সুলতানী যুগ (১৩৩৮-১৫৩৮)
১৩৩৮ সালে সোনারগাঁওয়ের শাসক বাহরাম খানের মৃত্যুর পর তার রাজকর্মচারী ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলায় স্বাধীন সুলতানী যুগের সূচনা হয়।
সুলতানী যুগের উল্লেখযোগ্য শাসকবৃন্দ
- ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ: তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান এবং সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম জয় করেন। তার রাজধানী ছিল সোনারগাঁও।
- শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ: তিনি সর্বপ্রথম সমগ্র বাংলার অধিপতি হন এবং প্রাচীন জনপদগুলোকে একত্রিত করে 'বাঙ্গালাহ' নামকরণ করেন। তিনি "শাহ-ই-বাঙ্গালাহ" উপাধি ধারণ করেন।
- সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ: তিনি বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন এবং তার শাসনামলকে বাংলার 'স্বর্ণযুগ' বলা হয়। তিনি ধর্মীয় উদারনীতি অনুসরণ করতেন এবং তাকে 'বাংলার আকবর' বলা হতো। তিনি গৌড়ের ছোট সোনা মসজিদ নির্মাণ করেন।
- গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ: তিনি সুলতানী আমলের সর্বশেষ শাসক ছিলেন। ১৫৩৮ সালে শেরশাহ গৌড় দখল করলে বাংলায় স্বাধীন সুলতানী যুগের অবসান ঘটে।
মুঘল সাম্রাজ্য
মুঘল সাম্রাজ্য ভারতে মুঘলদের শাসনকালকে নির্দেশ করে। ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবর লোদী বংশের ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে মুঘল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। ১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে সম্রাট আকবর বাংলায় মুঘল শাসনের সূত্রপাত করেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবের পর শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসনের মধ্য দিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন হয়।
পানিপথের তিনটি যুদ্ধ
হরিয়ানার পানিপথ নামক স্থানে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
- প্রথম যুদ্ধ (১৫২৬): বাবর ও ইব্রাহীম লোদীর মধ্যে সংঘটিত হয়। বাবরের জয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়।
- দ্বিতীয় যুদ্ধ (১৫৫৬): বৈরাম খান ও হিমুর মধ্যে হয়। এই যুদ্ধে দিল্লি মুঘলদের নিয়ন্ত্রণে আসে।
- তৃতীয় যুদ্ধ (১৭৬১): আবদালী ও মারাঠাদের মধ্যে হয়, যা মারাঠা সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করে।
মুঘল সম্রাটগণ
- সম্রাট বাবর: তিনি ছিলেন মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। পিতার দিক থেকে তৈমুর লঙ এবং মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। তিনি সাহসিকতার জন্য 'বাবর' নামে পরিচিতি পান, যার অর্থ সিংহ। তিনি ভারতবর্ষে প্রথম কামানের ব্যবহার করেন এবং তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ 'তুযুক-ই-বাবর' বা 'বাবরনামা' রচনা করেন।
- সম্রাট হুমায়ুন: বাবরের মৃত্যুর পর তিনি সিংহাসনে বসেন। ১৫৪০ সালে শেরশাহের সাথে কনৌজের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি রাজ্য হারান। ১৫৫৫ সালে তিনি পুনরায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৫৫৬ সালে তিনি গ্রন্থাগারের সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা যান।
- সম্রাট শেরশাহ: তিনি চৌসার যুদ্ধে হুমায়ুনকে পরাজিত করে 'শেরশাহ' উপাধি ধারণ করেন। তিনি গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড নির্মাণ করেন এবং 'ঘোড়ার ডাক' ও 'দাম' মুদ্রার প্রচলন করেন।
- সম্রাট আকবর: মাত্র ১৩ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন। তার অভিভাবক ছিলেন বৈরাম খান। তাকে বাংলার মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়। তিনি 'দীন-ই-ইলাহী' ধর্ম, মনসবদারী প্রথা এবং বাংলা সাল ও বাংলা নববর্ষের প্রচলন করেন। তিনি জিজিয়া কর ও তীর্থকর রহিত করেন। আকবরকে মুঘল সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলা হয়।
- সম্রাট জাহাঙ্গীর: তার বাল্য নাম ছিল শেখ বাবা। তিনি বাংলায় মুঘল শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ১৬১০ সালে তার আমলেই ইসলাম খান বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে জাহাঙ্গীরনগর (ঢাকা) এ স্থানান্তর করেন।
- সম্রাট শাহজাহান: স্থাপত্য শিল্পের প্রতি বিশেষ আগ্রহের কারণে তাকে 'Prince of Builders' বলা হয়। তিনি আগ্রার তাজমহল, দিল্লির লালকেল্লা এবং ময়ূর সিংহাসন নির্মাণ করেন।
- সম্রাট আওরঙ্গজেব: তাকে 'জিন্দাপীর' বলা হয়। তার শাসনামলে বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন শায়েস্তা খান।
মুঘল স্থাপত্য ও অবস্থান
- লালবাগ কেল্লা: ঢাকা। নির্মাতা শায়েস্তা খান (শুরু করেন শাহজাদা আযম)।
- তাজমহল: আগ্রা। নির্মাতা শাহজাহান।
- লাল কেল্লা: দিল্লি। নির্মাতা শাহজাহান।
- ছোট কাটরা: ঢাকা। নির্মাতা শায়েস্তা খান।
- বড় কাটরা: ঢাকা। নির্মাতা শাহজাদা সুজা।
- সাত গম্বুজ মসজিদ: মোহাম্মদপুর, ঢাকা। নির্মাতা উমিদ খাঁ।
- তারা মসজিদ: ঢাকা। নির্মাতা মীর্জা গোলাম পীর।
বাংলায় মুঘল শাসন ও বারো ভূঁইয়া
১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধের পর সম্রাট আকবর বাংলায় মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেও, 'বারো ভূঁইয়া' নামে পরিচিত জমিদাররা তাদের অধীনতা মেনে নেয়নি। এদের নেতা ছিলেন ঈশা খাঁ। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে বারো ভূঁইয়াদের চূড়ান্তভাবে দমন করা হয়। মুঘল প্রদেশগুলো 'সুবা' নামে পরিচিত ছিল।
নবাবী শাসন
- মুর্শিদকুলী খান: তিনি ছিলেন বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব। তিনি রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন।
- সিরাজ-উদ-দৌলা: তিনি ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে তার পতন হয়।
ভারতে ও বাংলায় ইউরোপীয়দের আগমন
১৪৯৮ সালে পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো-দা-গামা ইউরোপ থেকে ভারতে আসার জলপথ আবিষ্কার করেন। ভারতবর্ষে পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজ, দিনেমার ও ফরাসি—এই পাঁচটি দেশের বণিকদের আগমন ঘটে। পর্তুগিজরা 'ফিরিঙ্গি' এবং তাদের জলদস্যুরা 'হার্মাদ' নামে পরিচিত ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬০০ সালে গঠিত হয় এবং ১৬০৮ সালে তারা বাংলায় আসে। কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জব চার্ণক।
ইংরেজ শাসন (১৭৫৭-১৯৪৭)
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতন হয়, যা বাংলায় ইংরেজ শাসনের সূচনা করে। ১৭৬৪ সালের বক্সারের যুদ্ধে মীর কাসিম পরাজিত হন এবং ১৭৬৫ সালে লর্ড ক্লাইভ বাংলায় দ্বৈত শাসন চালু করেন।
সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭)
১৮৫৭ সালে ব্যারাকপুরে সিপাহীরা প্রথম বিদ্রোহ করে। তারা দিল্লির বৃদ্ধ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে। বিদ্রোহের প্রথম শহীদ ছিলেন মঙ্গল পান্ডে। এই বিদ্রোহ সমর্থন করায় ইংরেজরা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করে এবং মুঘল সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পতন হয়।
রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পর্যায়
- কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা (১৮৮৫): অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম এটি প্রতিষ্ঠা করেন।
- বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫): লর্ড কার্জন বাংলা প্রদেশকে বিভক্ত করে 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' নামে নতুন প্রদেশ গঠন করেন।
- মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা (১৯০৬): নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ঢাকায় মুসলিম লীগ গঠিত হয়।
- বঙ্গভঙ্গ রদ (১৯১১): লর্ড হার্ডিঞ্জ বঙ্গভঙ্গ রদ করেন।
- লাহোর প্রস্তাব (১৯৪০): শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন, যা পরবর্তীতে স্বতন্ত্র বাংলাদেশের বীজ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ভাষা আন্দোলন (১৯৫২)
উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণার বিরুদ্ধে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্ররা প্রতিবাদ মিছিল বের করে। মিছিলে পুলিশের গুলিতে রফিক, আব্দুল জব্বার, আবুল বরকত, আব্দুস সালাম ও শফিউরসহ অনেকে শহীদ হন। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। এই আন্দোলনের প্রথম সংগঠন ছিল 'তমুদ্দিন মজলিস'। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন (১৯৫৪)
১৯৫৩ সালে চারটি বিরোধী দল নিয়ে 'যুক্তফ্রন্ট' গঠিত হয়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে এই জোট ২১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং নৌকা প্রতীক নিয়ে বিপুল ভোটে জয়ী হয়। শেরে বাংলার নেতৃত্বে গঠিত সরকার মাত্র ৫৬ দিনের মাথায় ভেঙে দেওয়া হয়।
ছয় দফা (১৯৬৬)
১৯৬৬ সালের ২৩ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা ঘোষণা করেন। একে 'বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ' বা 'পূর্ব পাকিস্তানের ম্যাগনাকার্টা' বলা হয়। এই কর্মসূচির প্রথম দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা (১৯৬৮)
ছয় দফা আন্দোলনকে দমন করার জন্য ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ফলে ২২ ফেব্রুয়ারি মামলাটি প্রত্যাহার করা হয়।
গণ-অভ্যুত্থান (১৯৬৯)
১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি 'সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ' গঠিত হয়। ২০ জানুয়ারি ছাত্র আসাদ এবং ২৪ জানুয়ারি ছাত্র মতিউর নিহত হন। এই আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে। এই দিনেই শেখ মুজিবকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধি দেওয়া হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধ (১৯৭১)
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। এর আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়ারলেসযোগে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে এম. এ. হান্নান এবং ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
১০ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী।
৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এই ভাষণে তিনি বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রস্তুতি ও আহ্বান জানান। ভাষণের শেষ উক্তিটি ছিল, 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। ২০১৭ সালে ইউনেস্কো এই ভাষণকে 'বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য' হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
বুদ্ধিজীবী হত্যা ও আত্মসমর্পণ
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দেশকে মেধাশূন্য করার উদ্দেশ্যে বহু বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানের পক্ষে জেনারেল নিয়াজী যৌথ কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এর মধ্য দিয়ে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসান হয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।