এখানে প্রশ্ন লোড হবে।
বাংলাদেশ, তার ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে যেমন পরিচিত, তেমনি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকির কারণেও দেশটি বিশ্বে বিশেষভাবে আলোচিত। কার্যকর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং টেকসই উন্নয়ন তাই বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রবন্ধে আমরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান, আন্তর্জাতিক আইন এবং বাংলাদেশের ভৌগোলিক ও কৃষিভিত্তিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করব।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা: সঠিক পদ্ধতি ও স্তর
যেকোনো দেশের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা একটি অপরিহার্য প্রক্রিয়া। এর কার্যকারিতা নির্ভর করে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর।
ব্যবস্থাপনার কার্যকরী স্তর
প্রাকৃতিক দুর্যোগ এককভাবে মোকাবেলা করা প্রায় অসম্ভব। এটি একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা, যেখানে সমাজের প্রতিটি স্তরের অংশগ্রহণ জরুরি। যদিও জাতীয়, আঞ্চলিক বা উপজেলা পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কাঠামো রয়েছে, গবেষণায় দেখা গেছে কমিউনিটি বা গোষ্ঠী পর্যায়ে গৃহীত ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি ফলপ্রসূ হয়। এর প্রধান কারণ হলো, স্থানীয় জনগোষ্ঠী তাদের পরিবেশ এবং সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো ধারণা রাখে। ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে দলবদ্ধভাবে কাজ করার মাধ্যমে দ্রুত সাড়া প্রদান, উদ্ধার তৎপরতা এবং ত্রাণ বিতরণ সহজ হয়। স্থানীয় জ্ঞান এবং সম্পদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা জাতীয় পর্যায়ের নিয়ন্ত্রণের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার পর্যায়ক্রম
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কাজগুলো একটি নির্দিষ্ট চক্র অনুসরণ করে করা হয়। এই চক্রের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো ঝুঁকি (Risk) চিহ্নিতকরণ। সম্ভাব্য দুর্যোগের ধরন, এর তীব্রতা এবং ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে ধারণা না থাকলে পরবর্তী কোনো পদক্ষেপই কার্যকর হবে না। ঝুঁকি চিহ্নিত করার পরই আসে দুর্যোগ প্রস্তুতি, দুর্যোগ প্রশমন এবং সবশেষে পুনর্বাসন পর্যায়। পুনর্বাসন পর্যায়ে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত সম্পদ, পরিবেশ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা হয়।
পরিবেশ ও প্রাকৃতিক ঘটনা
পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান এবং প্রাকৃতিক ঘটনাবলি পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করে। এদের পরিবর্তন জীবনযাত্রার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
বায়ুমণ্ডলের গঠন
আমাদের চারপাশের বায়ুমণ্ডল বিভিন্ন গ্যাসের মিশ্রণ। এর প্রধান উপাদান হলো নাইট্রোজেন (N₂), যার পরিমাণ প্রায় ৭৮.০২%। দ্বিতীয় প্রধান উপাদান হলো অক্সিজেন (O₂), যা প্রায় ২০.৭১%। এছাড়া বায়ুমণ্ডলে আরগন (Ar) (০.৮০%), কার্বন ডাই অক্সাইড (CO₂) (০.০২%) এবং স্বল্প পরিমাণে নিয় নিয়, হিলিয়াম, ক্রিপ্টন, জেনন, হাইড্রোজেন, মিথেন ও ওজোন গ্যাস রয়েছে। বায়ুমণ্ডলের মোট শক্তির প্রায় ৯৯.৯৭% আসে সূর্য থেকে, যা ক্ষুদ্র তরঙ্গ আকারে বিকিরণ প্রক্রিয়ায় পৃথিবীতে পৌঁছায়।
আপদ (Hazard) ও এর প্রভাব
আপদ (Hazard) বলতে বোঝায় কোনো আকস্মিক ও চরম প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট ঘটনা, যা জীবন ও সম্পদের ওপর আঘাত হানে। আপদের প্রত্যক্ষ প্রভাব হলো পরিবেশগত। যেমন—ভূমিকম্প, বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের ফলে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বর্তমান বিশ্বে বায়ু দূষণ এমনই একটি মারাত্মক আপদ, যা পৃথিবীতে মানুষের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বায়ু দূষণের ফলে ক্যান্সার, নিউমোনিয়ার মতো ভয়াবহ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট: ভূগোল, কৃষি ও দুর্যোগ
বাংলাদেশের ভৌগোলিক গঠন, কৃষি ব্যবস্থা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার অভিজ্ঞতা একে অন্যটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। মেঘনা এদেশের দীর্ঘতম, বৃহত্তম ও প্রশস্ততম নদী। অন্যদিকে, পদ্মা সবচেয়ে নাব্য এবং কর্ণফুলী সবচেয়ে খরস্রোতা নদী। ভৌগোলিক কারণে এদেশের একেক অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য একেক রকম। যেমন, কিশোরগঞ্জ জেলায় হাওড়-বাঁওড়ের মতো নিচু ভূমির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। আবার, উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল (রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর) সবচেয়ে বেশি খরা প্রবণ। শুষ্ক মৌসুমে একটানা ২০ দিন বা তার বেশি বৃষ্টিপাত না হলে তাকে খরা হিসেবে গণ্য করা হয়। একটি অঞ্চলের জলবায়ু মূলত এর অক্ষাংশ, উচ্চতা এবং সমুদ্রস্রোতের ওপর নির্ভর করে; দ্রাঘিমারেখা এক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলে না।
কৃষি ব্যবস্থা
বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা মূলত ধান-প্রধান নিবিড় স্বয়ংভোগী প্রকৃতির। এর অর্থ হলো, এখানকার কৃষকরা প্রধানত নিজেদের ভোগের জন্য নিবিড় পদ্ধতিতে ধান চাষ করেন।
দীর্ঘস্থায়ী দুর্যোগের প্রভাব
বাংলাদেশে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে। তবে সমুদ্রের জলস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং এর ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস জনগণের জীবিকার ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। সমুদ্রের পানি ঢুকে পড়লে কৃষি জমি লবণাক্ত হয়ে পড়ে এবং ঘরবাড়ি ও অবকাঠামো স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে জলবায়ু উদ্বাস্তুর (Climate Refugee) সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক পূর্বাভাস অনুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৪৫ সেমি বাড়লে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে প্রায় ৩.৫ কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে পারে।
আন্তর্জাতিক আইন ও সম্মেলন
পরিবেশ রক্ষা এবং দুর্যোগ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে নানা চুক্তি ও সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সমুদ্র আইন কনভেনশন (Law of the Sea Convention)
১৯৮২ সালে জ্যামাইকাতে স্বাক্ষরিত এবং ১৯৯৪ সাল থেকে কার্যকর হওয়া এই আইন অনুযায়ী, উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলোর সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করা হয়। এই আইন অনুসারে, একটি দেশের রাজনৈতিক সমুদ্রসীমা উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল, অর্থনৈতিক সমুদ্রসীমা (Exclusive Economic Zone) ২০০ নটিক্যাল মাইল এবং মহীসোপান (Continental Shelf) এলাকা ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত।
ধরিত্রী সম্মেলন ও অন্যান্য প্রটোকল
১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরিওতে অনুষ্ঠিত ধরিত্রী সম্মেলন (রিও সম্মেলন নামেও পরিচিত) পরিবেশ সুরক্ষায় একটি মাইলফলক। ওজনস্তর ক্ষয়রোধের জন্য মন্ট্রিল প্রটোকল (১৯৮৭) এবং জৈব নিরাপত্তা বিষয়ে কার্টাগেনা প্রটোকল (২০০০) দুটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চুক্তি।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও গ্রিনহাউস
শিল্পায়নের ফলে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রধান কারণ।
গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া
গ্রিনহাউস মূলত শীতপ্রধান দেশে গাছপালাকে তীব্র ঠান্ডা থেকে রক্ষা করার জন্য নির্মিত একটি কাঁচের ঘর। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলও গ্রিনহাউসের মতো কাজ করে। কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেনের মতো গ্যাসগুলো পৃথিবীর তাপকে ধরে রেখে তাপমাত্রা বাড়িয়ে তোলে। মাথাপিছু গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের ঝুঁকি
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। এর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ব সাহায্যের প্রায় ৩০% বাংলাদেশকে প্রদান করা উচিত।
পরিশেষে বলা যায়, কার্যকর স্থানীয় পর্যায়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমেই বাংলাদেশ তার প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে পারে।